রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে

Home/রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে
See this post 2,141 views

রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে

(রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ পর্ব-০১)

মংডু ॥ রাখাইন রাজ্য ॥ মিয়ানমার

সীমান্ত শহর মংডুর অদূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি পাহাড়ি গ্রাম। নাম ফাতংজা। প্রভাত সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে প্রতিদিন যখন দূর পাহাড়ের মাথায় সোনালি আলো ঝিলমিল করে, তখন মনটা খুবই উৎফুল্ল হয় সাদের। পাহাড়ি কিশোর সাদের জন্ম এই গ্রামে। এই গ্রামের জল হাওয়া, মাটি-পাহাড়, বন জঙ্গল নদী তার খুবই ভালো লাগার স্থান। অবশ্য এই গ্রামের বাইরে খুব একটা যাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর।

ফজরের নামাজের পরে প্রতিদিন ও প্রতীক্ষায় থাকে কখন দিগন্ত রাঙা করে সূর্যের আগমন ঘটবে আর সে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখবে। ছোটবেলা থেকে এই একই দৃশ্য দেখতে খারাপ লাগেনি তার বরং প্রতিদিনই যেন সে নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন রূপে; নতুন সূর্যের আগমনে। ঠিক তেমনি সন্ধ্যা বেলা যখন দূর পাহাড়ের মাথায় নারিকেল গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য অস্তগামী হয় সেদিকে উদাস নয়নে চেয়ে থাকে ও। তারপর সন্ধ্যার আবীর ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকার গ্রাস করে নেয়, তখনই ওর বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে। আবার মাঝে মাঝে মনেও পড়ে না, যখন দীর্ঘ নারিকেল শাখার উপরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পূর্ণিমার চাঁদ, তখনও তন্ময় হয়ে বসে থাকে। ঘরে ফেরার কথা ভুলে যায়। উদাস হয়ে ও ভাবতে থাকে জীবনের অপার রহস্য।

প্রতিদিনের মতো ভোরবেলা সূর্যোদয় দেখার পর গরু-মহিষ নিয়ে মাঠে যায় সাদ। পাহাড়ের পাদদেশে গরু-মহিষগুলো চরতে থাকে আর ও পাহারা দেয় যেন কারো ফসলের ক্ষতি না হয়। অবশ্য ফাতংজা গ্রামের অধিকাংশ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, রাখাইন রাজ্যের অন্যান্য গ্রামের মতো শুধু আছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার। গ্রামের ষাট ভাগ লোকের নিজস্ব কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা চাষ অথবা মাছ ধরা কিংবা স্বল্প মূলধনী দোকান চালিয়েই দিন কাটে তাদের।

বর্ষাকালে এখন ধান চাষের সময়। সাদ গরু-মহিষগুলো নিয়ে মাঠে আসে আর ওর বড় দুই ভাই লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করে। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মহিষের লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে ওরা।গরুর চেয়ে মহিষের চাষে অনেক সুবিধা এবং বেশি চাষ করা যায়। মহিষের গায়ে শক্তি বেশি। গরুর তুলনায় দ্বিগুণ চাষ করা যায়। ওদের আটটি মহিষ ও ছয়টি গরু। চারটি মহিষ দিয়ে চাষ করে বড় দুই ভাই লুদু ও হালা। বাকিগুলো দেখাশোনা করে সাদ। পুরো নাম সাদ উল্লাহ।

সাদের বাবা আজিমুল্লাহ মূলত একজন কৃষক। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে ওরা। আজিমুল্লাহর মোট সাত সন্তান। চার ছেলে এবং তিনটি মেয়ে। সাদ ছেলেদের মধ্যে তৃতীয় এবং ভাই-বোনদের মধ্যে পঞ্চম। সাদের ছোট আরো একটি ভাই ও বোন আছে। মা আজারা খাতুন। গৃহিণী, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা আর ঘর সামলাতেই দিন কেটে যায় তার।

প্রতিদিনের মতো গরু-মহিষগুলো মাঠে চরতে দিয়ে বসে আছে সাদ। বেলা একটু বাড়লেই বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে আসে ছোট ভাই রামাদ উল্লাহ। আজ বেশ বেলা বেড়েছে; কিন্তু রামাদ উল্লাহ এখনো আসেনি। মনে মনে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ও ক্ষুধার যন্ত্রণায়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় অপেক্ষা করা যে কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। মনে মনে বেশ রাগতে থাকে সাদ। ভাইরা তবুও মহিষের পিছন পিছন হাঁটছে, ওদের সময় কেটে যাচ্ছে; কিন্তু বসে বসে অপেক্ষার সময় আর কাটে না সাদের।

এমন সময় খিদেটা আরো বেড়ে যায় পাশের বাড়ির মেয়ে গোল চেহেরকে ওর আব্বার জন্য ভাত নিয়ে যেতে দেখে। গোল চেহের পাশ দিয়ে যাবার সময় কেমন করে যেন বুঝে ফেলে ওদের ভাত নিয়ে এখনো আসেনি। তাই সে জিজ্ঞাসা করে- কি? এখনো ভাত আসেনি বাড়ি থেকে?
একথা শুনে সাদের রাগ আরো বেড়ে যায়। ও রেগে গিয়ে বলে ওঠে, তাতে তোমার কি?
কেন জিজ্ঞাসা করতে নেই বুঝি?
নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে, আমাকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই।
গোল চেহের বুঝল সাদ আজ ক্ষুধার চোটে প্রচ- রেগে আছে। অন্যদিন হলে কখনোই সে এভাবে কথা বলতো না তার সাথে।
সূর্যের দিকে তাকিয়ে বুঝল বেশ বেলা হয়েছে। তার নিজেরও মনে হচ্ছিল আজ দেরি হয়েছে। প্রায় দশটা বাজার মতো অবস্থা। এখনো ভাত আসেনি-রাগ তো হবেই; কিন্তু বুঝতে পেরেও ও সাদকে আরো রাগানোর চেষ্টা করে। বললো- যার তেল দেওয়া অভ্যাস সে চরকা পেলেই তেল দেয়।
সাদ এবার রীতিমতো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে- যাও ভাগো। আমার সাথে কথা বলতে এসো না।
গোল চেহের সাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে ক্ষেতের দিকে চলে যায়।

একটু পরেই ওদের তিন ভাইয়ের জন্য ভাত নিয়ে আসে রামাদ। রামাদকে দেখেই রাগ আরো বেড়ে যায় সাদের। ভাতের গামলা নামিয়ে রাখার সাথে সাথে ও চটাশ করে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় রামাদের গালে। তারপর ভাইদের আসার আগেই ও খেতে থাকে। লুদু ও হালা ভাত এসেছে দেখে হাল ফেলে খেতে চলে আসে। এসে দেখে রামাদ কাঁদছে সাদের চড় খেয়ে। আর সাদ খাচ্ছে গপ গপ করে পান্তা আর কাঁচা মরিচ দিয়ে। সাথে একটু শুঁটকি। রামাদের কান্না দেখে মেজ ভাই হালা ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় সাদের গালে। ওর হাত থেকে ভাতসহ থালা মাটিতে পড়ে যায়। এক হাত দিয়ে গাল ডলতে থাকে সাদ। তাই দেখে ফিক করে হেসে ফেলে রামাদ। সাদের ভাত আর খাবার উপযোগী থাকে না মাটি মিশে যাওয়ায়। হালা ওর থালায় ভাত নিয়ে খেতে থাকে। লুদু ভাত নিয়ে দেখে যে আর ভাত নেই। ওদিকে সাদ চুপচাপ বসে আছে দেখে বড় ভাই তার থালা থেকে ভাত নিতে বলেন, কিন্তু সাদ বসে থাকে চুপচাপ। স্থির।
লুদু কম খেয়ে সাদের জন্য রেখে দেয় কিছুটা তারপরও সে বসে থাকে চুপ করে। বড় দুই ভাই চলে যাওয়ার পর সাদ বলে ওঠে- তোর জন্য আজ মার খেলাম আমি।
তুমিও আমাকে মারলে কেন? ভালই হয়েছে মারের শোধ মেজ ভাই দিয়ে দিয়েছে!
দেব কিন্তু আবার।
হ্যাঁ দিয়ে দেখ। মেজ ভাইকে আবার বলে দিব। কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নাও, আমি থালা-গামলা নিয়ে বাড়ি যাব।

অগত্যা কোনোদিকে সুবিধা করতে না পেরে সাদ খেয়ে নেয়। নয়তো ক্ষুধা সহ্য করতে হবে। তার নিজের অংশ তো নষ্ট হয়েছে এটাও হাতছাড়া হবে। খাওয়া শেষ হলে রামাদ বাড়ি চলে যায়। অবশ্য রামাদকে সাদ খুব ভালোবাসে। দুই ভাইয়ের খুনসুটি, মারামারি- গলা জড়াজড়ি সবই চলে।

সাদ বসে থাকে একা একা পাহাড়ের পাদদেশে আর গরু-মহিষগুলোর ওপর নজর রাখতে থাকে। সাদের সময় কাটতে চায় না এ সময়। একা একা কি আর সময় কাটে? সবার গরু চাষে ব্যস্ত কিন্তু ওদের গরু-মহিষ একটু বেশি থাকায় ওর সমস্যা। এগুলো পাহারা দিতে হয়। অন্যরা পাহারা দেয় দুপুরের পর থেকে কিন্তু সাদকে পাহারা দিতে হয় সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দুপুরের পরে সবাই আসে দেখে তখন সময় কেটে যায়। কিন্তু দুপুরের আগের এই দুই তিন ঘন্টা সময় কাটতে চায় না কিছুতেই। মাঝে মাঝে একাকিত্ব ভোলার জন্য ও তার বাঁশিতে সুর তোলে। বাঁশের বাঁশি। অনেকগুলো ছিদ্র থাকে। বাজানোর জন্য আলাদা কৌশল লাগে। সাদ সেটা খুব ভালো পারে। এমন সময় বাবার ভাত খাওয়ানো শেষ করে ফিরে আসে গোল চেহের। দেখে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে সাদ। ও মুগ্ধ হয়ে সাদের পাশে বসে শুনতে থাকে বাঁশির সুর। সাদ খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারে। বাঁশিতে যখন ও করুণ সুর তোলে তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে তার মেলোডি। এই কিশোর বয়সে ও যে কীভাবে এত সুন্দর বাজাতে পারে এটা অনেকেই ভেবে পায় না। তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছিল সাদ আর ওর পাশে বসে গালে হাত দিয়ে অনুভব করছে গোল চেহের। কিছুক্ষণ পর সাদ ওর বাঁশি বাজানো থামালে গোল চেহের বললো- থামলে কেন?
থামবো না তো কি সারাদিন বাজাব?
ভালই তো লাগছিল?
ভাল তো লাগবেই, ভাল লাগবে বলে কি আমাকে সারাদিন বাজাতে হবে?
তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?
কীভাবে কথা বলছি?
কীভাবে বলছো বুঝতে পারছো না? এত ভাব দেখানোর কি হল? একটু বাঁশি বাজাতে পার বলে?
আমি তোমাকে কখন ভাব দেখালাম?
এই যে এখন দেখাচ্ছ, সেই প্রথম থেকেই কেমন করে কথা বলছো? এমন করলে আমি চলে যাবো।
যাও তোমাকে বসে থাকতে কে বলেছে?
সত্যি! আমি চলে গেলে তো তোমার আবার খারাপ লাগবে। যাই তাহলে বলে গোল চেহের যাওয়ার ভান করে উঠে দাঁড়াল।
সাদ দেখলো গোল চেহের সত্যি সত্যি বোধ হয় চলে যাচ্ছে, তাই সে তাড়াতাড়ি বললো-

না না যেও না। বসো, যাওয়ার সময় আমাকে ওভাবে বলে গেলে কেন? আমার বুঝি রাগ হয় না?

কি আর বলেছি। আমি তো কিছুই বলিনি, শুধু জিজ্ঞেস করেছি। ঠিক আছে, আর তোমার ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করবো না, এতই যদি রাগ হয়।
গোল চেহেররা ছয় ভাই-বোন। চার বোন দুই ভাই। ও মেজ, ভাই দুটি বড়, বাবা নুর ফয়সাল, মা শাকিফা বেগম, তার ছোট আরো দুটি বোন আছে।

ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি এভাবে বেড়ে উঠেছে সাদ ও গোল চেহের। সাদের জন্ম ১৯৭৪ সালে এবং গোল চেহের তার পরের বছর। প্রতিবেশী হওয়ায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওদের কর্মক্ষেত্র প্রায় কাছাকাছি। এভাবে কথা-গল্পে ওদের সময় কেটে যায়। অবশ্য সারাক্ষণ এভাবে বসে বসে গল্প করার ফুরসত মেলে না সবসময়, কারণ মহিষগুলো খুবই দুরন্ত। এই নদীতে সাঁতরায় তো একটু পরেই নদীর ওপারে সবুজ ঘাসের দিকে নজর দেয়। মন চাইল তো নদীর ওপারে লম্বা লম্বা ঘাসের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে না থেকে দল বেঁধে পাড়ি জমায় ওপারে। ওপারে আবার অন্যদের ক্ষেত। ওপারে উঠলেই ফসল নষ্ট করে। সেজন্য দ্রুত আবার ওদের ফেরত আনতে যেতে হয়। যেদিন দু-একটি মহিষ এপারে থাকে সেদিন আর অসুবিধা হয় না, একটার পিঠে চেপে ও নদী পার হয় এবং অন্যগুলোকে নিয়ে আসে। এজন্য ও সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখে যাতে মহিষগুলো সব একসাথে ওই পারে চলে না যায়। যদি দেখে সব চলে যাওয়া শুরু করেছে তখন ও দৌড়ে এসে পিছনেরটার পিঠে ওঠে, ততক্ষণে হয়তো সামনেরটা মাঝ নদী পার হয়ে গেছে।

মহিষগুলো বড় আজব চিজ। সারাক্ষণ সাদকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। ওদের গতিও গরুর চেয়ে অনেক বেশি। যেদিন সব মহিষ একত্রে ওপারে চলে যায় তখন মহাবিপদে পড়ে সাদ। কেননা তখন অন্যের ভরসায় বসে থাকতে হয়। ওপার থেকে কেউ দয়া পরবশ হয়ে যদি মহিষগুলো ফেরত পাঠায় তবেই রক্ষে, না হলে ওর কপালে সেদিন জোটে চরম বকুনি। কারণ ফসল ক্ষেতের মালিক বাড়িতে নালিশ করে। এজন্য মাঝে মধ্যে মেজভাই হালার কাছে মার খেতে হয়। মেজভাইকে যমের মতো ভয় পায় ও। প্রচন্ড শাসন করে ওকে। সাদ মেজভাইকে মোটেই পছন্দ করে না। পরিসংখ্যান কিন্তু বলে ভিন্ন কথা। পরিবারের সবচেয়ে সফল সন্তান নাকি মেজো ছেলে কেননা সে জন্মের পর থেকে ভাগাভাগির জন্য বড় ভাইকে পায় কিন্তু বড় ভাই প্রথমে জন্মগ্রহণ করায় বাবা-মায়ের বিশেষ আদর যত্ন পায়। আর ছোটরা তো সবসময় মায়ের স্পেশাল নজরদারিতে থাকে। মেজো ছেলে এজন্য আদর কম পায় এবং বন্ধুবৎসল হয়। সে পরিবারে বেশি একটা মনোযোগ না পেয়ে বাইরে বন্ধু-বান্ধবদের সময় বেশি দেয় এবং সেখানে তার একটা সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে তার এই মনোভাব সমাজ সেবা বা ব্যক্তিজীবন গঠনে কাজে লাগে।

মেজভাই হালার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে সাদ ভীত থাকে। তার একার পক্ষে নদী সাঁতরে পার হওয়ার সাহস হয় না এই চৌদ্দ বছরের কিশোর বয়সে। যদিও ও খুব ভাল সাঁতার জানে। গোল চেহেরের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে বলতে সময় চলে যায়। অনেক সময় ও গরু আনতে গেলে গোল চেহের চলে যায়।
আজও কিছুক্ষণ গল্প করার পর গোল চেহের চলে গেল। তারপরেই পড়ল ও মহাবিপদে। নদীর দিকে তাকিয়ে দেখে সব মহিষ ওপারে চলে গেছে এপারে শুধু একটা। ও তখন তড়িঘড়ি করে এই মহিষটাকে তাড়িয়ে নদীতে নেমে পড়ে। নদী পার হতে থাকে মহিষের পিঠে ও একাকী। মহিষটা ভারী বজ্জাত। মাঝ নদীতে গিয়ে পানিতে ডুব দেয়। ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ থাকে। সাদ মহিষের সাথে সাথে ডুব দিয়ে নদীর গভীরে চলে যায়; কিন্তু ওর দম শেষ হয়ে আসে। তখন মহিষকে ছেড়ে দিয়ে ও নদীতে একা ভেসে ওঠে। এপারে ওপারে কেউ নেই। চারদিকে শূন্য। মহিষের চিহ্ন কোথাও নেই। মাঝ নদীতে ও একা। ভীষণ ভয় পেয়ে যায় ও। সারাক্ষণ শুধু মনে হতে থাকে এই বুঝি ওর পা ধরে টেনে নিয়ে যাবে কোনো কিছুতে! কিশোর জীবনের সারল্য, ভীতি আর মাঝ নদীতে একা ও। এরকম পরিস্থিতিতে না পড়লে আসলে বলে বুঝনো যাবে না- ভয় কাকে বলে। অবশেষে মহিষ সামনে কিছুদূর গিয়ে ভেসে ওঠে, ও সাঁতরে পিঠে গিয়ে ওঠে। আবার ডুব দেয় মহিষ। সাদ ভাবে যত অসুবিধা হোক এবার আর ঘাড় ছাড়বো না। মহিষ ডুব দিলেই লাঠি দিয়ে খোঁচাতে থাকে ও পানির ভিতরে ওটার পিঠে; এভাবেই এ যাত্রা রক্ষা পায়।

সাদ প্রতিদিন মহিষ পাহারা দেয় যোহরের নামাজের আজান দেওয়া পর্যন্ত। আজান শোনা গেলে ও গরু-মহিষগুলো নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। দুপুরে খেয়ে দেয়ে বিকেলে আবার মাঠে আসে গরু-মহিষগুলো নিয়ে; ততক্ষণে ভাইদের লাঙ্গল চাষ শেষ হয়। চাষের মহিষগুলো তখন বেশি ক্ষুধার্ত থাকে তাই ওদের দিকে অধিক নজর দিতে হয়। অবশ্য বিকেল বেলা গ্রামের সবাই আসে গরু-মহিষ চরাতে। তখন সময়টা বেশ কাটে ওদের। সবাই একসাথে অনেক আনন্দ করে ওরা- কখনো খেলা, কখনো গল্প, কখনো মারামারি আবার কখনো নদীতে সাঁতার কেটে।
বিকেল গড়িয়ে সূর্য আস্তে আস্তে দূর পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হতে থাকে। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম দিগন্তে, যেখানে পাহাড়ের পাদদেশে সমুদ্র তার অসীম সৌন্দর্য অপূর্ব জলরাশি বিছিয়ে রেখেছে। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে যায় নীল পানির ভিতর একটি থালার মতো। আস্তে আস্তে গোধূলির রঙ বিলীন হতে থাকে। নাম জানা-অজানা শত শত পাখি ডাকতে ডাকতে নীড়ে ফেরে। দূর মসজিদ হতে ভেসে আসে মাগরিবের আজানের ধ্বনি। ক্লান্ত, বিষণ্ন কাদামাখা শরীর নিয়ে গরু-মহিষের পিছন পিছন কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে প্রতিদিনের মতো ঘরে ফেরে সাদ।চোখ রাখুন “রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ ২য় পর্বে”।

২৪হেল্পলাইন.কম/মে ,২০১৮/মোঃ সিরাজুল ইসলাম-এফসিএ

By | 2018-10-18T06:59:06+00:00 May 9th, 2018|Comments Off on রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে