রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে

Home/রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে
See this post 1,851 views

রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে

(রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ পর্ব-০২)

মংডু ॥ রাখাইন রাজ্য ॥ মিয়ানমার

তুলাতলী গ্রাম। বার্মিজ নাম ‘মিন গি’। মংডু টাউনশীপ। পশ্চিম মিয়ানমার। আদর্শ পাহাড়ি গ্রাম। নদী, পাহাড়, সমুদ্র, গাছ-গাছালিতে ভরা। পারমা নদী বয়ে গেছে তিন দিক দিয়ে, স্রষ্টা তার নিপুণ হাতে শিল্পীর তুলিতে এঁকেছেন যেন এই গ্রাম। দু’পাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত। মাঝখান দিয়ে সরু মেঠো পথ। পথের শেষ প্রান্তে সবুজে ঘেরা বিশাল বিশাল নারিকেল গাছ আর সরু সরু সুপারি বন। মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের ঘর। বেশির ভাগ গ্রাম্য ঘরবাড়ি কাঠের তৈরি।অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের বাড়িগুলো মাঝে মাঝে চোখে পড়ে দুইতলা করা। এই দ্বিতল বাড়ি কিন্তু ট্রেডিশনাল বিল্ডিং নয়, কাঠের দোতলা। এমনকি দোতলায় ওঠার জন্য কাঠের সিঁড়ি আছে। খুব জোরে কাঠের উপর দিয়ে হাঁটলে বা দৌড়ালে পুরো বাড়ি কাঁপতে থাকে। এসব বাড়ির পিছনে বুনো লতাগুল্ম আর নাম না জানা কিশলয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে গেছে পারমা নদী, দূরে বিশালতার প্রতীক সমুদ্র, বঙ্গোপসাগর। পাহাড়ের তিন পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পারমা নদী। মাঝে মধ্যে দু-একটা পাহাড়ের গায়ে ঝরনার দেখাও মেলে। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের টেকনাফ, কক্সবাজার। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত।

প্রকৃতি সব সৌন্দর্য উদার হস্তে দান করেছে, শুধু উন্নতি হয়নি, ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা দারিদ্র্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষগুলোর। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থা, নেই মানসম্মত স্কুল-কলেজ; নেই চিকিৎসক, হাসপাতাল নেই। গ্রামের সত্তর ভাগ মানুষ অশিক্ষিত যা দুই-একজন ডাক্তার আছে তারাও গ্রামে থাকতে চায় না। সামান্য অসুখ-বিসুখে মৃত্যুই এখানে নিত্য দিনের ঘটনা। গ্রাম্য ডাক্তার অথবা কবিরাজই একমাত্র ভরসা অথবা মুরব্বিদের পরামর্শে গাছ-গাছড়ার ওষুধ।

গ্রামে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। শুধু একটি প্রাইমারি স্কুল আছে। সেজন্য অধিকাংশ ছেলেমেয়ে প্রাইমারির আগেই ঝরে পড়ে। মেধাবী আর অতি উৎসাহী ছেলে-মেয়ে ছাড়া তেমন কেউ লেখাপড়া করে না। অবশ্য যাদের কার্ড আছে তারা ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারে না।

ঠিক সেরকম দু’জন ছেলে-মেয়ে হচ্ছে আয়াস ও শকুরা। ওদের কার্ড আছে। দু’জন গ্রামে ভালো কোনো স্কুল না থাকায় পড়তে যায় দূরের গ্রামে। তারা গ্রাম থেকে প্রাইমারি শিক্ষা, পাশের গ্রামে মধ্যবর্তী শিক্ষা শেষ করে এখন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

দু’জনের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় ওরা একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। দু’জনেই সমবয়সী। ১৯৮৫ সালে জন্ম আয়াসের এবং ওর তিন মাস পরেই জন্ম শকুরার। ওরা এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে।

পড়াশোনায় আয়াস বেশ ভাল। শ্রেণিতে তার অবস্থান প্রথম দিকে থাকে সবসময়। শকুরা অতটা মেধাবী না হলেও মাঝারি মানের ছাত্রী। এজন্য ও সব সময় আয়াসের সহযোগিতা নিয়ে চলে।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে শকুরা জিজ্ঞেস করে- বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে তুমি কি হতে চাও?
আমি আসলে জানি না কি হতে চাই?
এটা আবার কেমন কথা, তোমার জীবনের লক্ষ্য কি তুমি জান না! পরীক্ষার খাতায় রচনা তো ঠিকই লিখে ফেলো চার-পাঁচ পাতার।
ওটা তো মুখস্ত।
তাই বলে তোমার কি নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা প্ল্যান নেই?
ইচ্ছা থাকলেই কি আর সব হবে! কত মানুষের কত ইচ্ছা থাকে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, বড় চাকরি- কত কিছু। কিন্তু আমি শুধু নিজের জীবনের স্বপ্ন পড়ার জন্য বলতে পারি; কিন্তু নিজের জীবনের এত বড় স্বপ্ন ভাবতে পারি না।

কেন পার না? ভাবলেই তো হয়। নির্ধারণ করলেই তো হয়।
না শুধু লক্ষ্য নির্ধারণ করলেই হয় না। আমাদের এখানে সে সুযোগ কি আছে? তুমি কি বলতে পার মাধ্যমিক শেষের পর আমরা কোথায় ভর্তি হব? বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ আমাদের কোথায়? তুমিই বলো মাধ্যমিকের পর তুমি কি করবে? কোথায় ভর্তি হবে?
তা তো জানি না।
এই তো বুঝতে পেরেছ। আমিও জানি না মাধ্যমিকের পর কোথায় ভর্তি হব- কোথায় যাব। এখানে তো সুযোগ নেই। বড় শহরে যেতে হবে, উচ্চ শিক্ষার জন্য। জীবনে কি হবে জানি না। তবে আমার খুব পড়াশোনার শখ, আমার খুব উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন। আমাদের সমাজের মানুষগুলোর দিকে চেয়ে দেখো বেশিরভাগ দারিদ্র্যপীড়িত, অশিক্ষিত, কুসংস্কার আর অশিক্ষার অন্ধকারে ভরা আমাদের চারপাশে। এজন্য আমার খুব ইচ্ছা শিক্ষিত হয়ে আমি গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াব। ওদের মুখ উজ্জ্বল করবো। জানি না সে সুযোগ পাবো কি না!
আচ্ছা এটা কী রকম ব্যাপার যে আমরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাব না আর অন্যরা পাবে!
আমি অতশত বুঝি না। কিন্তু বাস্তবতা দেখ- আমাদের গ্রামের কি কেউ উচ্চ শিক্ষিত আছে? অথবা কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা উচ্চ পদের কেউ?
তাইতো। আসলেই তো কেউ নেই। দু-একজন বড়জোর মাধ্যমিকের গ-ি পার হয়েছে। তারপর থেমে গেছে জীবন, তাদের অবস্থা হয়েছে আরো দুর্বিষহ। না পারছে সবার মতো কাজ করতে, না পারছে ভালো কোনো চাকরি করতে! এ এক মহা সমস্যা।
ঠিকই বলেছো। এজন্য আমি ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাই না। কি যে করবো দিশেহারা হয়ে যাই। অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগোনো বড়ই কঠিন, লক্ষ্য না থাকলে কি উদ্দেশ্য পূরণ হয়? দেখ না আমাদের বাড়ির কথাই ধরো। সবাই তো ভাবে, আমি ছুতো দিয়ে কাজ ফাঁকি দেই। শুধু শুধু পড়াশোনা করে কি হবে? ওরা বলে আমাদের সাথে এসে কাজ শেখ। তাহলে আর পরবর্তীতে কষ্ট হবে না। লেখাপড়া শিখে সময় নষ্ট করিস না।পরে পস্তাবি।
দেখো, আমাদের এখানে সামাজিক অবস্থান লেখাপড়া করার কত অনাগ্রহ। অথচ অন্য সমাজে, ইয়াংগুনেও দেখ লেখাপড়ার জন্য বাবা-মা’রা সন্তানদের কত যত্ন নেয়। আর আমাদের উল্টো বাধা দেয়।
ঠিক, বলে লেখাপড়া করে কি করবি! শেষমেষ ওটাও হবে না কাজও শিখবি না। মাঝ থেকে প্রতিদিন ভাইদের কাছে বকা খেতে হয়।
বকা খেতে হয় কেন?

কেন আবার? আমি ভোরে উঠে পড়তে বসলে ওরা বলে কাজে ফাঁকি দেবার জন্য বই নিয়ে বসে আছে। বলে- আমাদের সাথে আয় ক্ষেতের কাজটা কর, তোর ভাগের কাজ কে করবে? মাঝে মাঝে সকালে আমি ঠিকমতো পড়তে পারি না। ওদের সাথে কাজ করি তারপর ভাত খেয়ে স্কুলে চলে আসি। শুধু রাতে পড়ি। বড় ভাই মাঝে মাঝে বকা দেয়। বলে ছোট ভাই রাবিব পর্যন্ত কাজ করে আর তুই শুধু ফাঁকি দিস পড়ার কথা বলে। ফাঁকিবাজ একটা। বলে আরো বেশি কাজ দেয়।

আয়াসরা তিন ভাই এবং দুই বোন। বড় ভাই রশিদ, সে মেজো এবং রাবিব ছোট। এছাড়া আরো দু’টি বোন আছে, বোন দু’টির মধ্যে হানজা আয়াসের বড় এবং ছোটটির নাম আয়েশা।
আয়াস হাঁটতে হাঁটতে আবার বলে- সারাদিন পরিশ্রম করে পড়ালেখা করি। আবার রাতেও পড়ি। রাতে কেউ কিছু বলে না। তবে বর্ষাকালে ওদের সাথে সারাক্ষণ বিলে কাজ করতে হয়। তখন দুই মাস আবার পড়াশোনা বন্ধ থাকে। স্কুলে যেতে দেয় না, আব্বার থেকেও সাপোর্ট পাই না। বলেন- আমরা তো অত বড়লোক না আয়াস, নিজের কাজ একটু না করলে তো দিনমজুর ধরতে হবে। কিয়েট পাবো কোথায়? ধান লাগানো শেষ হলে আবার তুমি স্কুলে যেও। ব্যস, মাঝখান থেকে আমার দুমাস নেই। পড়াশোনা, প্রতিযোগিতা, দুই মাস গ্যাপ। ওরা কি বুঝবে, ওরা শুধু বোঝে ওদের সাথে কাজ করো।
মন খারাপ করো না। একদিন সবাই বুঝবে পড়ালেখার মূল্য।
কচু বুঝবে। সেদিন কবে আসবে জানি না। আদৌ সেই দিন আসবে কি না আমি জানি না! তবে যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, যত দুঃখের দিন আসুক, বেদনার চোরাবালি যদি আমাকে আরো সিক্ত করে তোলে তারপরও আমি চেষ্টা করে যাব উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার জন্য। উচ্চ শিক্ষিত আমাকে হতেই হবে। তা যে কোনোভাবেই হোক। হোক সেটা রাখাইনের রাজধানী সিত্তেতে, অথবা ইয়াংগুনে; অথবা অন্য কোনো শহরে কিংবা হতে পারে বিদেশে।
তোমার এই দৃঢ় মনোবল দেখে খুবই ভালো লাগলো। দোয়া করি তুমি সফল হও। আমারও জীবনের একটা লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। ভাবি, পরে এ নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করবো।
কথা বলতে বলতে ওদের গ্রাম এসে পড়ায় যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

প্রতিদিন এভাবে সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যায় ওরা। মিয়ানমারের শিক্ষা ব্যবস্থা চারটি ভাগে বিভক্ত যেমন-

১. প্রাইমারি শিক্ষা (Primary Education)
২. মধ্যবর্তী শিক্ষা (Middle Education)
৩. মাধ্যমিক শিক্ষা (Secondary Education)
৪. উচ্চ শিক্ষা (Tertiary/Higher Education)

প্রাইমারি স্কুল লেভেলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হয়, তারপর মধ্যবর্তী লেভেলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তারপর নবম ও দশম শ্রেণির পর হয় মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা। তারপর পাস করলে উচ্চতর শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। মিয়ানমারের শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্নীতিতে ভরপুর। সাধারণত ভালো স্কুলগুলোতে সরকারি যোগাযোগ এবং ভালো রেফারেন্স ছাড়া ভর্তি হওয়া যায় না। উল্লেখ্য, প্রতিটি লেভেলে পাস না করলে পরের লেভেলে যাওয়া যায় না এবং গরিব, সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীরা এজন্য প্রাইমারি লেভেল পার হতে পারে না। এখানেই ফেল করে মধ্যবর্তী লেভেলে উত্তীর্ণ হতে পারে না। এ কারণেই ঝরে যায়।
আয়াস ও শকুরা প্রতিদিন একসঙ্গে স্কুলে যাতায়াত করে। অবশ্য কৃষি কাজের দিনগুলোতে আয়াস অনেক দিন ক্ষেতে কাজ করার জন্য আসতে পারে না; তখন শকুরাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় একাকী।
ওদের ক্লাসে প্রায় ৭০ জন ছাত্রছাত্রী। এদের মধ্যে সব ধরনের ছেলে-মেয়ে আছে। ওদের মধ্যে মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান সবই আছে।
আয়াসের বন্ধুদের মধ্যে আছে রমেত, আয়ান, ফয়েস, বিতানী; শকুরার বান্ধবীদের মধ্যে তাহা, রুবিদা, তৈয়বা। ওরা একসাথে বসে এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও বান্ধবী আছে।
ওদের ক্লাসে বর্তমান ফার্স্ট বয় জো এবং সেকে- একটি মেয়ে নাম লি; এছাড়া ম অং, সু, চেরী এবং ছেলেদের মধ্যে আরনল্ড, স্মিথ, রেভো, সেইন ও হেইন আছে।
জো বরাবর প্রথম হয় বলে ওর অহঙ্কারটা একটু বেশি এবং মাঝে মধ্যে লি ও আয়াসের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। এভাবে ওদের নবম শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হয়। এবারও জো যথারীতি প্রথম হয় এবং লি দ্বিতীয়; কিন্তু আয়াস অঙ্কে ২ নম্বরের জন্য ফেল করে। জীবনে যা কোনোদিন হয়নি তাই হয় আয়াসের। লেখাপড়া নিয়ে জীবনে ওর এই প্রথম ব্যর্থতা। সব সাবজেক্ট মিলে মোট পাস করে ২৫ জন। আয়াসের রোল হয় ২৫ জনের পরে ২৬তম অর্থাৎ ও যে মার্কস পেয়েছিল তাতে ও ঠিকই দ্বিতীয় হতে পারত কিন্তু অঙ্কে ফেল করায় ২৬তম হয়েছে। স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝিম মেরে বসে থাকে আয়াস। ও বুঝতে পারছে কীভাবে কি হয়েছে!
ও জানে কোথায় ওর দুর্বলতা, ও তো ঠিকমতো অঙ্ক পারে না। এদিকে দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। বাড়ির পিছনে নদীর ধারে নারিকেল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে ও। ওর জীবনের প্রথম ব্যর্থতা কীভাবে ঝেড়ে ফেলে সামনে এগোনো যায় সেই চিন্তায় মনটা অস্থির। শেষ বিকেলের আলো ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ক্রমে নেমে আসে রাতের অন্ধকার, তবুও চুপচাপ নদীর তীরে বসে ও ভাবছে আর ভাবছে। পশ্চিম আকাশের দীর্ঘ নারিকেল শাখার উপরে পাহাড়ের মাথায় উঁকি দেয় একফালি নবমীর চাঁদ।

চাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পায় ও। এই যেমন চাঁদ ক্ষয়ে যায় আবার পূর্ণিমা রাতে পরিপূর্ণ হয়ে ফিরে আসে, মানুষের জীবনেও এমন উত্থান-পতন আছে। কিছুক্ষণ পর ডুবে যায় ক্ষণস্থায়ী নবমীর চাঁদ। তারপর নদী তীর থেকে কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঘরে ফেরে আয়াস। ওকে সামনের বছর দশম শ্রেণির পরীক্ষায় প্রথম হতেই হবে। যেভাবেই হোক। যত পরিশ্রম হোক। এ তার অঙ্গীকার।

পরদিন স্কুলে গেলে জো, ম অং, রেভো এরা খুব টিটকারি দেয় আয়াসকে।
জো তো বলেই বসলো- আরে ও আবার কি পাস করবে? লেখাপড়া হবে নাকি ওর! ওরা তো রোহিঙ্গা, একটু পড়ছে, দু’দিন পরে আর স্কুলেই আসবে না। কথাটা শুনেই আয়াসের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রি রি করে জ্বলে উঠলো।
ও বললো- কেন? তোমাকে কি কেউ ভবিষ্যৎ বাণী করেছে নাকি আমার লেখাপড়া হবে না, নাকি তুমি জোতিষী হয়ে গেছ? তোমার নিজের হবে নাকি সেদিকে খেয়াল রাখো।
জো রেভোর দিকে তাকিয়ে টিটকারি মার্কা হাসি দিয়ে বললো- ফেল করেছে, আবার দেখ বড় বড় কথা। আর আমি হলাম প্রথম। আমার সাথে তুলনা করে। সাহস দেখ কত বড়!
হ্যাঁ, সাহস আছে বটে আমার। তোকে যদি সামনের বার তোর জায়গা থেকে না নামাতে পারি তো আমার নাম আয়াস না।
হ্যাঁ কর আগে। তারপর দেখা যাবে। ফেল করে আবার চ্যালেঞ্জ!
ফেল করেছি তো কি হয়েছে? তুই সামনের বার দেখবি এর পরিণাম কি হয়!
তুই কি আমাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিস?
হ্যাঁ জানাচ্ছি। তোর মতো চুনোপুটিকে টেনে নামিয়ে দেখিয়ে দেব আমি কে? উত্তেজিত হয়ে বললো আয়াস।
ওদিকে জো-ও সমান তালে উত্তেজিত হচ্ছে। মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার মতো অবস্থা। মাঝ থেকে আবার ফোড়ন কাটলো ম অং। পারলে করে দেখাও না, এত কথার দরকার কি? এখন তো পারনি, যখন পারবে তখন কথা বলতে এসো। খামোখা প্যাঁচাল পাড়ে।

আয়াসের অহংবোধে ঘা লাগলো ম অং-এর কথা শুনে। রাগত স্বরে বলল- দেখে নিস সামনে। তুই তো সারাক্ষণ জো’র পিছনে জোঁকের মতো লেগে থাকিস দেখে লেখার ধান্দায়। তোর নিজের কোনো যোগ্যতা আছে?
শুনে ম অং এবং জো আরো রেগে গেল। ওরা এগিয়ে এলো আয়াসের দিকে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে সব ছাত্র-ছাত্রী চলে এসেছে এদিকে। শকুরাও এসেছে সবার সাথে।
শকুরা আয়াসের হাত ধরে টান দিয়ে ভিড়ের মধ্য হতে বাইরে এনে বলল- রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তো মাথা গরমের দরকার কি? সামনের পরীক্ষায় ভালো করলেই তো হলো। চলো তো।
আয়াস তারপরও উত্তেজিত হয়ে ওদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো- সামনের পরীক্ষার জন্য তৈরি থাকিস। তোর অহঙ্কারের পতন হবেই! বেশি অহঙ্কারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।
আরে যা যা, দেখা আছে তোর মতো আয়াস। কতো দেখলাম এই পর্যন্ত। কত হাতি গেল তল, মশা বলে কত জল। হা হা হা- ফেলের মধ্যে ফার্স্ট হবি। এবার যেমন হয়েছিস, হা হা হা…

রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আয়াসের ওর হাসি দেখে। আর কোনো কিছু বলার আগেই শকুরা ওর হাত ধরে টেনে স্কুলের বাইরে নিয়ে আসে এবং বাড়ির দিকে অগ্রসর হয় ওরা। চোখ রাখুন “রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ ৩য় পর্বে”।

২৪হেল্পলাইন.কম/মে ,২০১৮/মোঃ সিরাজুল ইসলাম-এফসিএ

By | 2018-10-18T06:57:06+00:00 May 10th, 2018|Comments Off on রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারে