বাংলাদেশ তথা অনুন্নত দেশে, অবাধ ঔষুধের ব্যবহারে কোন বিধি নিষেধ না থাকায়, যথেচ্ছাভাবে গ্রামের মানুষ হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছ থেকে সময়ে অসময়ে শিশুদের কিংবা বয়স্কদের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছেন। গ্রামের বাজার ঘাটে লক্ষ্য করলেই দেখবেন, ঔষুধ যেন সেখানে মুড়ি মুড়কির মত চলে। এমন যথেচ্ছা ঔষুধের ব্যবহার নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই, থাকলেও এর ভয়াবহতা নিয়ে তেমন কোন সচেতনতা আছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি কখনো। তবে, কপালগুনে আমি এর কিছুটা ঠিক আঁচ করতে পারছি। তার কারন, আমার কয়েকজন সহপাঠী আজ যখন এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্টস রোগ-জীবানু নিয়ে ল্যাবে গবেষনা করছেন, আর তাদের মুখে শুনতে পাই আগামী দিনে আমাদের জন্য কি ভয়াবহ পরিনতি অপেক্ষা করছে সেসব খবর।
আজকাল আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করিছি যে, বেশীর ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের শরীরে আর আগের মত কাজ করছেনা। কারন, ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাস এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণী যারা প্রকৃতির প্রতিকুল পরিবেশে লড়াই করে টিকে থাকার কৌশল নিজেরাই অর্জন করতে সক্ষম। এখন ভাবছেন এর সাথে অ্যাান্টিবায়োটিকের কি’ইবা সম্পর্ক, তাইতো? আচ্ছা তবে বুঝিয়ে বলছি। ধরুন, আপনি সচেতন বলে ঔষুধ সেবনে সাবধান থাকেন। কিন্তু, আপনার প্রতিবেশী অসচেতনভাবে সামান্য কারনে অসুখ-বিসুখে ইচ্ছেমত অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে নিয়ে থাকেন। এরপর তিনি খোলা যায়গায় পায়খানা প্রস্রাবও করেন, যেটা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদী নালা হয়ে কিংবা ভুগর্ভস্ত পানির সাথে মিশে গিয়ে আবারো পানি চক্রে আমাদের খাবার পানির সাথে চলে আসে, তাতে আপনি সরাসরি কোন অ্যান্টিবায়োটিক নিলেননা ঠিক আছে, তবুও আপনি আপনার শরীরে নানাভাবে পরিবেশ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহন করছেন। আবার বাসায় অব্যবহৃত ঔষুধ, মেয়াদ শেষে নিশ্চয় আপনি নিকটস্থ জলাশয় কিংবা বাড়ির পার্শের নর্দমায় ফেলে দিচ্ছেন। এসবের ফলে অনেকটা সিগারেট না খেয়ে বন্ধুর পাশে দাড়িয়ে ধোয়া খাওয়ার মতই পরোক্ষভাবে আমাদের শরীর চলে আসে এসব অ্যান্টিবায়োটিকস। আবার একজন অসুস্থ রোগী একটা দুটো ডোজ খেতেই সুস্থ্য হয়ে যাওয়ায় ঔষুধের পুরো ডোজ শেষ না করেই অ্যান্টিবায়োটিক নেয়া বন্ধ করে দেন, এতে ব্যাকটেরিয়া উক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগীর শরীরে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে প্রতিরোধী শক্তি অর্জন করে ফেলে। এভাবে গোটা দেশের কথা একবার চিন্তা করেন, যেখানে বাংলাদেশের হসপিটালগুলোর প্রতিদিনের রোগীর মলমুত্র কিংবা হসপিটালের মারাত্বক সব বর্জ্য, যথাযথ পরিশোধন না করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার ঔষধ কোম্পানির ফ্যাক্টরির বর্জ্যপানি মিশে যাচ্ছে প্রাকৃতিক জলাশয়ে। আর কোন একসময় সে জলাশয় থেকেই পানি উত্তলোন করে সিটি কর্পোরেশন তথা পানি সরবরাহ প্রতিষ্ঠান আপনার বাড়িতে পানি সাপ্লাই দিচ্ছে। যেটা আপনি আমি প্রতিদিন নির্বিঘ্নে খেয়ে চলেছি নিরাপদ পানীয় হিসেবে।
পানিতে এই এন্টিবায়োটিকের মিশ্রণ এতটাই লঘু পরিমানে থাকে যা সাধারণত প্রচলিত পধতিতে ট্রিটমেন্ট করে পানি থেকে এসব ক্ষতিকর পদার্থ দুর করা সম্ভব নয়। এমনকি পানি ফুটিয়ে কিংবা প্রচলিত ফিলটার ব্যবহার করেও এইসব মাইক্রো পলিউট্যান্ট পানি থেকে অপসারণ করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের হাতে কিছু উন্নত টেকনোলজি আছে যেগুলি দারা অমন ক্ষতিকর পদার্থ পানি থেকে আলাদা করা সম্ভব হলেও, তা অত্যান্ত ব্যয়বহুল। এমনকি, কি করে অল্প খরচে এ ধরনের দুষিত ক্ষতিকর পদার্থ পানি থেকে আলাদা করা যায়, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ গবেষনা শুরু করেছেন মাত্র কয়েক বছর আগে। বর্তমানে হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজিতে আমার বিভাগের চারজন সুনামধন্য প্রফেসর এ ব্যাপারে গবেষনা করছেন। তাদের অধীনে বড় একটা গবেষক দল রাতদিন এ নিয়ে গবেষনা করে চলেছেন।
আপনি ইতমধ্যেই টের পেয়েছেন যে, আগের বার আপনি বা আপনার সন্তানের জর হওয়ায় যে ঔষধটি সেবনে সুস্থ্য হয়ে গিয়েছিলেন অথচ, আজ সে একই ঔষধে কোন কাজ হচ্ছেনা। তাই ডাক্তার সাহেব চটকরে আরেকটা নতুন ঔষুধ লিখে দিচ্ছেন। তবে হংকং-এ সম্প্রতি এফসিপিএস করতে আসা এক বড় ভাইয়ের কাছে জানলাম, সারা পৃথিবীতে সর্ব সাকুল্যে মাত্র সাত ধরনের এন্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। যেখানে, যত কোম্পানির, যত এন্টিবায়োটিক আপনি দেখেন না কেন, তারা ঘুরে ফিরে এই সাত শ্রেণীতেই পড়বে। মুশকিল হচ্ছে একটা শ্রেণী রেসিস্ট্যান্ট মানে সেই শ্রেণীর মোটামুটি অন্য সব ড্রাগস গুলোও রেসিস্ট্যান্ট হবে। এবার বুঝলেনতো এর ভয়াবহতা। তার মানে এভাবে চলতে থাকলে অতি সাধারন অসুখেও একসময় হাজার হাজার মানুষ মরে যাবে আপনার আমার চোখের সামনে। তাই, আমাদের সচেতনতার সাথে সাথে সরকারী নীতিমালার কঠোর প্রয়োগ অসম্ভাবী। অন্যথায়, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কপালে কি যে দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে, তা স্বয়ং স্রিষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
২৪হেল্পলাইন.কম/এপ্রিল, ২০১৮/
হাসনাত বাদশা, হংকং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত বাংলাদেশী ছাত্র