রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ পর্ব-০৫

Home/রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ পর্ব-০৫
See this post 1,880 views

রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ পর্ব-০৫

ফাতংজা, প্রত্যন্ত রোহিঙ্গা পল্লী। মংডু। মিয়ানমার।

হেমন্তের বিকেল। চারদিকে ধানে ঈষৎ পাকা রং ধারণ করেছে। সাদ বসে আছে পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে। ভাবছে পড়ন্ত সূর্যের ম্লান আলোর মতো জীবনও হয়তো শেষ হয়ে যাবে কোনো একদিন। সূর্য ডুবে যাবে, সেও ডুবে যাবে জীবনের পাতা থেকে। জীবন কি বিচিত্র! এই জন্মানো, এই পৃথিবীর বুকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা আবার মৃত্যুর কোলে নিজেকে অসহায় আত্মসমর্পণ করে দেওয়া। কি অর্থ আছে এই জীবনের! একমাত্র বিধাতা জানেন। প্রতিদিন সূর্য ডুবে যায়; পরদিন ভোরে আবার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে উদিত হয়। কিন্তু মানুষের জীবনের সুখ একবার ডুবে গেলে আর উদিত হয় না। জীবন একবারই। জীবন একটিই। পৃথিবীতে কত জায়গা, কত মানুষ, কত সৌন্দর্য, কত রূপ, রস, গন্ধ তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সবই কি এক জীবনে দেখা সম্ভব? জানে না ও। জানে না বলেই আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। অজানা জিনিসের উপরে মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণের জন্যই তো মানুষ অজানাকে জয় করতে পারে।

মাঝে মাঝে নিজেকে ভাবুক মনে হয় সাদের। ও যে রকম ভাবে, সবাই কি সে রকম চেষ্টা করে জীবনের অর্থ খুঁজতে? কই কাউকে তো বলতে শুনি না। সাদ এখন জীবন নিয়ে বেশ ভাবে। আর ভাবে গোল চেহেরকে নিয়ে। আসলে ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না সাদ, ছোটবেলা থেকে দুজন একসাথে বড় হতে হতে এখন ও একুশে পা দিয়েছে। গোল চেহেরের বিশ বছর। গোল চেহেরের দেহে এখন যৌবনের ছোঁয়া। সাদেরও মনের ভিতর কোথায় যেন ওকে দেখলে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সারাজীবন ওকে দেখছে কিন্তু এখন ওকে দেখলে যেন অন্যরকম অনুভূতি হয়। একদিন না দেখলে যেন মনে হয় কি নেই। এটা কেন হচ্ছে ভেবে পায় না ও। গোল চেহেরেরও কি এমন হচ্ছে? জিজ্ঞাসা করে দেখা যেতে পারে। ও যদি লজ্জা পায়। ভাবতে ভাবতেই গোল চেহের এসে ওর পাশে বসে। বললো- কি ব্যাপার, কি করছো?
কি আর করবো। এখন তো কাজ কম তাই বসে বসে ভাবছি।
কি ভাবছো?
সাদ ভাবলো গোল চেহের কি শুনতে চায় আমি তার কথা ভাবছি, বলেই দেখি না কি হয়? মুখে বললো- তোমার কথা ভাবছিলাম।
আমার কথা আবার কি ভাবছো? আমি আবার কি করলাম!
কিছু করনি। কিন্তু….
কিন্তু কি? বলে ফেল
ভাবছি… মানে….
মানে মানে করছো কেন? বলে ফেল
বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না।
আমাকে নিয়ে তোমার এখনো এত সংকোচ কেন? বলে ফেল। সাহস দিল গোল চেহের।
লজ্জায় আরক্তিম হয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে সাদ আস্তে আস্তে বললো- আমার এখন কেমন জানি লাগে¬-
কেমন লাগে?
শুধু তোমার কথা মনে হয়। তোমাকে না দেখলে মনটা ছটফট করে।
সে তো আমারও হয়।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি তো। তোমাকে দেখা ছাড়া কি আমার একদিনও কাটে?
তা অবশ্য কাটে না। কিন্তু এখনকার অনুভূতিটা জানি কেমন… উদাস উদাস লাগে। মনে হয়… মনে হয়…
কি মনে হয়? উদগ্রীব হয়ে সাদের মুখ থেকে শুনতে চায় গোল চেহের।
মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। তোমাকে ছাড়া আমি বোধ হয় চলতে পারবো না।
আমারও এরকম মনে হয়।
সত্যি! তুমিও তাহলে আমাকে অনুভব করো? ভালোবাসো?
ভালোবাসি কিনা জানি না তবে তোমার কথা না ভাবলে আমার দিন কাটে না। তোমার কাছে না এলে আমার মন ছটফট করে। তোমার বাঁশির সুর না শুনলে আমি অস্থির হয়ে যাই।
হু, তাহলে ঠিকই আছে, তুমিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো। আমার বন্ধু জিয়াবুলও তাই বলছিল, ওর সাথে আমি আমাদের কথা শেয়ার করেছি।
তুমি ওর সাথে আমাদের কথা বলেছ কেন?
তাতে কি হয়েছে? আমাদের কথা সবাই জানে, তুমি ছাড়া আমি যে প্রাণহীন এটা সবাই জানে। শুধু আমরাই এতদিন বুঝতে পারিনি, অবশ্য আমি বেশ কিছুদিন আগেই বুঝেছি।
কবে?
যেদিন রাতে তুমি বাঁশির সুর শুনে পিঠা নিয়ে এলে সেদিন। ওইদিন আমার মনে ছুঁয়ে গেছে ভালোলাগার পরশ, সেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি তোমাকে আমি ভালোবাসি!
লজ্জায় লাল হয়ে গেল গোল চেহেরের রাঙা মুখ। ও শুধু বলতে পারল- আচ্ছা।
তারপর দু’জনেই চুপচাপ। করো মুখে কোনো কথা নেই। গোল চেহের ঘাস ছিঁড়ছে আর সাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সম্পর্কের এই নতুন মাত্রা লাভ করায় ওরা দু’জনেই দিশেহারা। ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে! এতদিনের স্বাভাবিক চলাফেরা, জীবন যাপন, আজ যেন থমকে গেছে নতুন সম্পর্কের সূচনায়, সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকার নেমে আসে ধরণীতে, আর দূরে ওই পাহাড়ের কোলে, ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। দু’জনেই নিস্তব্ধ, বসে আছে নির্বাক। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গের দায়িত্ব নিল সাদ। যখন সবকিছু মৌন থাকে তখন ছেলেদেরকেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়, বললো- কিছু বলছো না যে…
কি আর বলবো, সবই তো বলে দিয়েছ।
তাই বলে তোমার মতামত থাকবে না?
আমার আর মতামত কি? আমি কোনোদিন তোমার বিরুদ্ধে গিয়েছি?
সাদ বুঝলো গোল চেহেরের সম্মতি আছে, তাই সে আস্তে আস্তে বললো নতুন এই সম্পর্কের সূচনা থেকে আমি তোমাকে আর গোল চেহের বলে ডাকবো না।
তা হলে কি বলবে?
শুধু চেহের বলে ডাকবো, আমার আদরের চেহের; কি রাজি? বলেই চেহেরের চিবুক উঁচু করে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো। কিন্তু সাঁঝের আঁধার ঘন হয়ে আসায় কেউ কারো চোখ দেখতে পেল না।
জীবনে যা করেনি সাদ তাই করলো এই প্রথমবার। দু’হাত বাড়িয়ে গোল চেহেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলো সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকারে। থরথর করে কেঁপে উঠলো গোল চেহের জীবনের প্রথম প্রেমের স্পর্শ পেয়ে। তারপর মুখ নামিয়ে এনে ভালোবাসার প্রথম চুম্বন এঁকে দিল গোল চেহেরের মুখে।
ঝরা পালকের মতো থরথর করে শিহরিত হতে থাকল গোল চেহের। সাদ জড়িয়ে ধরে রাখলো ওকে কিছুক্ষণ। একটু পরে যেন সন্বিত ফিরে পেল গোল চেহের। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সাদের বাহুবন্ধন হতে। তারপর দৌড় দিল বাড়ির দিকে। ততক্ষণে আঁধার পুরোপুরি নেমে এসেছে ধরণীর বুকে।
ঠোঁটে তৃপ্তির পরশ নিয়ে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল সাদ। প্রথম ভালোবাসার প্রথম স্পর্শে ওর বুকটাও দুরুদুরু করছে শিহরণে, অজানাকে জানার উত্তেজনায়, অচেনাকে চেনার আনন্দে, অনাঘ্রাতা ফুলের সৌরভে।
বুকের দুরুদুরু আওয়াজ একটু কমলে প্রকৃতিস্থ হয় সাদ। তারপর আস্তে ধীরে আবার বসে পড়ে ঘাসের উপরে নারিকেল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে। আজ অন্ধকার রাত। বাঁশ বাগানের ঝোপে আর গাছের পাতার ফাঁকে জোনাকিরা জ্বলছে আর নিভছে। উপরে তারাভরা আকাশ। অন্ধকার রাতে নক্ষত্রেরা যেন বেশি বেশি জ্বল-জ্বল করে জ¦লে। তারার আলোয় ঈষৎ দেখা যায় পল্লীর পথঘাট।
অন্ধকার রাতের মেঘমুক্ত তারাভরা নীল আকাশ মুগ্ধ করে সাদকে। কত তারা আকাশে, এক জীবন ধরে যদি কেউ তারা গোনে তাহলে গুনে শেষ করা যাবে না। মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় কত কিছু সৃষ্টি করেছেন- অযুত নিযুত নক্ষত্র, উল্কাপি-, সৌরজগৎ, গ্যালাক্সি, চাঁদ, সূর্য, মঙ্গল, নেপচুন….নাম না জানা লক্ষ-কোটি গ্রহ, শত সহ¯্র আলোকবর্ষ দূরের অজানা রহস্য…..
একটু পরেই বাড়ি ফিরে আসে সাদ। এসেই দেখে রামাদের প্রচ- জ্বর এসেছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে অনেক তাপ, যেন হাত পুড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে মাথায় পানি ঢালা শুরু করে ওরা। কিছুতেই জ্বর কমছে না। রামাদের প্রচ- মাথা ব্যথা করছে। মাথার শিরাটা দপদপ করে লাফাচ্ছে।
কষ্টে বুকটা ফেটে যেতে চায় ওর। কিন্তু কিছু করার নেই। গ্রামে কোনো ডাক্তার নেই। যা-ও একজন আছে হাতুড়ে ডাক্তার তাও পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের গ্রামে। এই রাতে ডাকতে গেলে এতদূর আসবে না কিছুতেই। রাখাইনে এই আরেক ভয়াবহ সমস্যা। গ্রামগুলোতে কোনো ডাক্তার নেই, নেই কোনো ওষুধ। ভরসা শুধু কবিরাজ আর মুরব্বিদের দেওয়া গাছ-গাছড়ার ওষুধ।
প্রতিদিন এই মংডুতে, রাখাইনে যে কত অসহায় শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ মারা যাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। মৃত্যু এখানে আসে দৈনন্দিন কাজের মতো, কাজ সেরে আবার চলে যায় চুপিচুপি। মৃত্যু এখানে মানুষের নিত্য সাথী। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর মুখ বিছানায় রেখে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয়, যেতে হয় খাদ্যের সন্ধানে। আজরাইলের রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে বোধ হয় প্রতিদিন রাখাইনের কোনো না কোনো জায়গার নাম লেখা থাকে।
পরদিন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসে সাদ অনেক কষ্টে। ডাক্তার এসে দেখে তিনদিনের ওষুধ দিয়ে যায়।
রাতদিন রামাদের মাথার পাশে বসে থাকে সাদ। ওর চুলে হাত বুলায়। মাথা টিপে দেয়। ওর বড় আদরের ছোট ভাই রামাদ। একে অন্যকে ছাড়া চলতে পারে না। সাদ জিজ্ঞাসা করে তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে, ভাইয়া?
হ্যাঁ, ভাইয়া আমার শরীরে কোনো শক্তি নেই। কেমন জানি লাগছে।
ওষুধ খাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার দেখে গেছে। কোনো অসুবিধা নেই ইনশা আল্লাহ।
রামাদ আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে। এভাবে কেটে যায় আরো চার-পাঁচ দিন। জ্বর একটু কমেছে; কিন্তু মাঝে মাঝে আসে। রাতে আসে আবার দিনে চলে যায়। এভাবে আরো তিন চার দিন কাটে। সবাই আশায় আশায় আছে বোধ হয় সেরে যাবে।
ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে রামাদের শরীর। আবার ডাক্তার ডেকে আনা হয় কিন্তু গ্রাম্য ডাক্তার। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই। ডাক্তার বলেন- টাইফয়েড। ভাল হয়ে যাবে বলে- সাত দিনের ওষুধ দিয়ে চলে যান।
এভাবে কেটে যায় আরো দুদিন। একদিন দুপুরে রামাদ সাদকে বলে- ভাইয়া আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। তুমি আমার জন্য দোয়া করো।
কি যে বলিস পাগল, তোর কিছু হবে না। সান্ত¡না দেয় সাদ।
না ভাইয়া আমি বুঝতে পারছি, আমার সময় শেষ। শরীরে কোনো জোর নেই। উঠতে পারছি না। আমি মরে গেলে কি তোমার খুব কষ্ট হবে? আমার কথা তোমার মনে পড়বে তো? নাকি ভুলে যাবে?
সাদ রামাদের মুখে হাতচাপা দেয়। বলে- তুমি কি বলছো ভাইয়া ? তোমার কিছু হবে না। আল্লাহ এত নিষ্ঠুর না।
না ভাইয়া। তুমি ঠিক বলছো না। আল্লাহ নিষ্ঠুর। খুবই নিষ্ঠুর। তা না হলে আমাকে এত কষ্ট পেতে হয়! আমাদের এই গ্রামে, মংডুতে, রাখাইনে কত লোক বিনা চিকিৎসায় মরে যায়। আল্লাহ ওদের জন্য, আমাদের জন্য নয়। আল্লাহ ওদের উপর, অন্যায়কারীদের উপর গজব নাজিল করতে পারে না?
তুমি চুপ কর ভাইয়া। একটু বিশ্রাম নাও ঠিক হয়ে যাবে। ওকে বুঝায় সাদ।
না ভাইয়া আমাকে বলতে দাও। আর কখনো হয়তো বলতে পারবো না…
আমার জন্য দোয়া করো……….কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে ওর।
সাদ ওকে আদর করে শুইয়ে দিয়ে আসে, কিন্তু খেয়াল করে না রামাদ আর কথা বলতে পারছে না।
মাঝরাতে মা চিৎকার করে উঠে সবাইকে ঘুম থেকে তোলেন। কই! তোমরা কে কোথায় আছ? দেখে যাও, রামাদ কেমন করছে?
সবাই ঘুম থেকে উঠে ছুটে আসে। রামাদের শরীর দুবার ঝাঁকুনি দিয়েই নিস্তেজ হয়ে যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা। চোখ রাখুন “রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ পর্ব-০৬”।

২৪হেল্পলাইন.কম/সেপ্টেম্বর,২০১৮/মোঃ সিরাজুল ইসলাম-এফসিএ

By | 2018-11-11T05:30:01+00:00 September 15th, 2018|Comments Off on রোহিঙ্গা জীবনের গল্প-সীমান্তের ওপারেঃ পর্ব-০৫