“দুই পিপিলীকার জীবনের গল্প”

Home/“দুই পিপিলীকার জীবনের গল্প”
See this post 55,393 views

“দুই পিপিলীকার জীবনের গল্প”

সে বহুদিন আগের কথা, গুলিস্তানের পাবলিক টয়লেটের ঠিক পাশের একটা নোংরা গর্তে, নিতান্তই গরীব অসহায় এক দিনমজুর মন্টু নামের পিঁপড়া ও তার পরিবার অভাব অনটনের মধ্যে জীবন যাপন করত। তাদের সংসারে ফুলি আর কলি নামের বড় দুই মেয়ে আর মাঝে অলি নামের ৭ বছরের একমাত্র ছেলে তাও আবার পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছে । ছেলেটার পঙ্গুত্ব জন্মগত নয়। গত বছর মন্টু তার ছেলেপুলে সাথে নিয়ে এক দোকানে চিনির বস্তায় হানা দিতে গেলে, দোকানদারের হাতের তাল পাখার আঘাতে ছেলেটা জীবন নিয়ে কোনো রকম বেঁচে গেলেও আজীবনের জন্য একটা পা হারায়।

শুধু বর্ষাকাল বলে কথা নয়, দিনরাত সারাক্ষণ কলের পানির ছেটা পড়ে পড়ে মন্টুর বাসার মেঝে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। এ নিয়ে তার বউয়ের নানান অভিযোগ। বউ আবার এক বড়লোক পিঁপড়ার বাড়িতে বুয়ার কাজ করে। তবে তার অনেক বড় স্বপ্ন ভালো শুকনা একটা যায়গায় ছোটখাটো একটা বাসা ভাড়া নেবে, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করাবে। কিন্তু বস্তির দুষ্ট ছেলেপুলেদের সাথে মিশে মিশে তার তিন সন্তানের কাররই পড়াশুনায় আগ্রহ নেই। তাই মন্টুর বউয়ের মনে আজ শুধুই হতাশা আর মুখে সারাক্ষণ এক কথা, তাদের বিয়ের এতটা বছর পার হয়ে গেলেও সে নাকি এতটুকুন সুখের দেখা পেল না। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ঘরে এসে বউয়ের মুখে এমন চড়া কথা কার আর শুনতে ভালো লাগে। তাই প্রথম প্রথম হুঠহাঠ মন্টুর বউ পেটানোর একটা বদ অভ্যেস গড়ে উঠেছিল; তবে বউয়ের গলায় আজকাল কানের কাছে অমন ভাঙ্গা ক্যাসেটের পুরানো রেকর্ডিং বাজতে থাকলেও এ নিয়ে মন্টুর আর আগের মত রাগটাগ ওঠে না। রাগ হবে-ইবা কেন; ঠেলাগাড়ী ঠেলে যে দু-টাকা আয় হয় তা দিয়ে পাঁচজন লোকের দুবেলা তো ঠিকমতো খাবার-ই জোঁটে না। তাছাড়া বউ ছেলেমেয়ের জন্য বছরে ঐ একবার রোজার ঈদে সমাজের সজ্জন কোনো পিঁপড়ার দেওয়া যাকাতের টাকায় পরনের কাপড়-চোপড় জোঁটে কোনো রকম।

সেদিন শুক্রবার সপ্তাহের ছুটির দিনে দুপুরের খাবার খেয়ে কোনো রকম দু-চোখ বুজতেই অনেক চেঁচামেচির শব্দ শুনে হঠাৎ মন্টুর কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। এইদিকে মন্টুর বউ তো চিৎকার করে গোটা বাড়ি মাথায় তোলার উপক্রম। এবার মন্টু চরম বিরক্তি নিয়ে বউয়ের সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ল। “সারা সপ্তাহ গাধার মত খাটা খাটুনী করে সপ্তাহের একটা দিন যে একটু জিরিয়ে নেব তার ও জো নেই, এই মাগি তোর হইছে টা কি বল দেখিনি?” পাল্টা জবাবে মন্টুর বউ বলে, “কি আর হবে পড়া কপাল আমার! আজকাল ঘরের মধ্যি যে দুই এক পয়সা বা কোনো খাবার জিনিস রাখব তার জো আছে। রাখা মাত্রই ওটা মুহুর্তেই উধাও। ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করলে কেউ তো সেটা শিকারও করবে না। তবে ওরা না নিলে এই গরীবের ভাঙ্গা বাড়িতে কোন চোরের আমদানি-ইবা হবে শুনি।” আবার কদিন আগেও বাড়ির পাশের এক চায়ের দোকানে গিয়ে মন্টুর বড় মেয়ে নাকি ক্ষুধার জালায় প্যাকেট কেটে একটা পাউরুটির উপর উঠে খাবার চেষ্টা করে। তাতে নাকি হাতে নাতে ধরাও পড়েছিল। এতে এলাকার পিঁপড়াদের দলে অসহায় এ পরিবারটির আজ মুখ দেখাবার অবস্থাটুকুও নেই । এভাবেই মন্টু নামের অসহায় গরীব নিপীড়িত পিঁপড়ার পরিবারে প্রতিদিন-ই কোনো না কোনো অশান্তি লেগেই আছে।

ওদিকে পিন্টু হলো গুলশানের মত অভিজাত এলাকায় পাকা বাড়ীর গর্তে বসবাস করা ভি.আই.পি. জাতের পিঁপড়া। তারা সুখী পরিবার। তাদের ঘরে এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেমেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম বড় স্কুলে পড়ে। তাদের ছেলেমেয়েদের আদব কায়দাও খুব উঁচু মানের। শুনেছি স্ত্রী আবার গুলশান ক্লাবের পেছনের পিঁপড়া সংগঠনের মেম্বারও। বাসায় দামি ব্র্যান্ডের তিন তিনটা গাড়ী। বাগানের মালী, ড্রাইভার সহ তার বাসায় নাকি কাজের লোক-ই প্রায় এক ডজন কর্মী পিঁপড়া। সংসারে তাদের কোনো কিছুতেই কোন অভাব নেই। কারণ মিষ্টার পিন্টু নাকি বড় অফিসের খুব বড় একজন কর্মকর্তা। আবার শোনা যায় পিন্টুর বন্ধুদের তালিকায় নাকি দেশের স্বনামধন্য মন্ত্রী, দেশী বিদেশী শিল্পী, সাহিত্যিক, ব্যাবসায়ী নানান ক্ষমতাধর ব্যক্তিগণ রয়েছেন। তার অফিসে প্রতিদিন বৈধ অবৈধ লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার। আবার কোনো কোনো ক্লায়েন্ট পিন্টুর অফিসে বাজারের নতুন মডেলের আইফোন নিয়ে হাজির হন। এভাবে এক এক করে অনেকগুলো আইফোন গিফট পাওয়ায় স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবাইকে একটা করে দামী ফোন দেওয়া শেষ। তাই পিন্টু এবার বিরক্ত হয়ে তার নতুন ক্লায়েন্টদের ঘুষ কিংবা উপঢৌকন হিসেবে ফোন দিতে নিষেধ করেছেন। এদিকে অফিসের তার নীচের পদের অনেক অফিসারগণ বড় বসকে তেল মারতে নতুন কিছু অভিনব পন্থা অবলম্বন করছেন। যেমন-বাজার থেকে কেনা আম, কাঁঠাল, লিচু নিজের বাগানের কিংবা বড় বড় তরতাজা দেশী রুই-কাতলা নিজের পুকুরের মাছ বলে নিজ গরজে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। এভাবে মন্টুর জীবন আজ অফুরন্ত ভোগ বিলাসিতা আর সৌখিনতায় পরিপূর্ণ। তাই আজ সমাজে পিন্টুর অনেক সম্মান । থাকবে-ইবা না কেন; এলাকার মসজিদ-মন্দির নির্মানে সে বড় বড় ডোনেশন দেয়। মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাসায় বড় বড় পার্টি দেয় । সময় সময় গরু-খাসি কেটে বাবার দরগায় গিয়ে সিন্নি দেয়। তার ফেইসবুকের টাইম লাইনে নানান ধরনের জনহিতৈষী কর্মকান্ডের ছবিগুলো নিয়মিত আপডেট হয়। যেখানে লক্ষ লক্ষ ডিজিটাল পিঁপড়ারা দল বেঁধে লাইক এবং কমেন্ট দেয়। এইতো সেদিন ছুটির দিনে পিন্টু এক এতিমখানায় গিয়ে স্ব-পরিবারে এতিম শিশুদের সাথে নিয়ে একটা লাইভ ভিডিও পোষ্ট করেছিল । শুধু কী তাই, এ বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কতগুলো অসহায় পরিবারকেও সে নাকি বড় একটা ডোনেশন দিয়েছে। তাইতো চারিদিকে শুধু পিন্টুর ভালো কাজের সুনাম আর সুনাম। আজকাল পিন্টুর যে অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে অনেকে বলাবলি করছে আগামী বছর নির্বাচনে পিন্টুর নাকি পিঁপড়া সংগঠনের সরকার দলের হয়ে তার নিজ এলাকায় তিন আসনে এমপি প্রার্থী হবার ঘোর সম্ভবনাও আছে।

আসলে উপরের মিন্টু আর পিন্টু নামের পিপীলিকার ছদ্মনামে আমি সমাজের দুই শ্রেণীর মানুষের জীবনকে বোঝাতে চেয়েছি। আবার একই সাথে গল্পের প্রথম অংশের ‘মন্টু’ চরিত্রটি অনুন্নত দেশ এবং দ্বিতীয় অংশের ‘পিন্টু’ চরিত্রটি উন্নত দেশ হিসবেও কল্পনা করতে পারেন। এইবার আমার গল্পের প্রধান সে চরিত্র দুটি দিয়ে আমি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছি তা পরিষ্কার করে বলছি শুনুন। প্রথমেই আমরা যারা কথায় কথায় উন্নত দেশের নাগরিকদের জীবন যাপনকে আদর্শ ধরে আমাদেরকে সারাক্ষণ তুলনা করি তাদের কথায় আসি।

কখনও গভীর ভাবে খেয়াল করে দেখেছেন কি যেসব উন্নত দেশের নাগরিকদের জীবন অভাবমুক্ত তারা আসলে পিঁন্টুর ঘরে জন্ম নেওয়া ছেলেমেয়ের মতই। তাদের সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং আদব-কায়দা সবকিছুই অনুস্মরনীয়। তারা কেউ ক্ষুধার জালায় চায়ের দোকান থেকে পাউরুটি চুরি করে খেতে যায় না। কারণ তাদের ঘরে ফ্রিজ ভর্তি বহু পদের বাহারী স্বাদের খাবার সব সময় থাকে। আসলে ছোটবেলা থেকেই অভাব যে কি সেটা অনুভব করবার মত তারা তাদের জীবনে সুযোগ-ই পায় না। তাই বস্তিবাসী অসহায় মন্টুর ছেলেমেয়ের কাছে পিন্টুর ছেলেমেয়ের মত সুন্দর নির্মল জীবন-যাপন সব সময় অনুস্মরনীয় হয়ে থাকে। তবে এখানে বিশাল একটা তফাৎ আছে; যেমন মিন্টু গরীব হলেও শরীরের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের দ্বারা তার পরিবারের জন্য হালাল রুজির ব্যাবস্থা করে। অথচ মন্টুদের অভাবের তাড়নায় ছেলেমেয়ের সামান্য একটা পাউরুটি চোরের তকমা মাথায় নিয়ে সারাজীবন সমাজে নত শির নিয়ে বাঁচতে হয়।

অন্যদিকে সমাজে ‘পিন্টুর’ পরিবারের অনেক সুনাম অথচ পিন্টু কিন্তু বড় ধরনের চোর যে দেশের ক্ষতি করে লক্ষ লক্ষ টাকা অবৈধ পথে আয় করছে। অর্থাৎ সব কথার শেষ কথা হলো বাবা চোর তো সন্তান এবং তার পরিবার সমাজে সম্মানীত। আর যেখানে বাবা সৎ সেখানে সন্তান চোর এবং অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট চুরির অপরাধে সমাজে ধিকৃত। ঠিক তেমনি উন্নত কোন দেশ যেমন আমেরিকার কথায় যদি বলি তবে তারা সারা বিশ্বের যেখানে খুশি নাক গলায় আর যার তার সম্পদ নিজের করে নিতে কোন সমস্যা নাই। ইচ্ছা হলেই পারমানবিক বোমা মারলেও সমস্যা নেই। ইরাক, আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়ার মত দেশে যুদ্ধের নামে তাদের দেশের তেল সম্পদ দখল করলেও তাদের কেউ অপবাদ দেয় না। তাদের দুর্নিতী কিংবা অনিয়োম কিন্তু ছোটখাটো কোন বিষয়ে নিয়ে না। পিন্টুরা যেমন তার অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারকে অভাবমুক্ত রাখে ঠিক তেমনি একটা দেশের অভিভাবক হিসেবে সে দেশের সরকার আন্তর্জাতিক মহলে দুর্নীতি করে তাদের সংসার বলতে দেশকে তথা দেশের সন্তান মানে তার নাগরিকদের অভাবমুক্ত রাখে। যার কারনে তাদের ঘরের সন্তান মানে নাগরিকরা আমাদের মত গরীব অনুন্নত দেশের নাগরিকদের সামনে মন্টুর পরিবারের ছেলেমেয়েদের মত আদর্শ বনে যায়। আর মন্টুর অভাবী সংসারে বেড়ে ওঠা সন্তানদের মনে থাকে অনেক কিছু না পাবার সুপ্ত বাসনা, তারা লোভে পড়ে কখনও একটা আইফোনের জন্য আবার কখনও ক্ষুধার জ্বালায় একটা সামান্য পাউরুটির জন্য।

এইবার উন্নত দেশকে কেন পিন্টু মিয়াঁর সাথে-ইবা তুলনা করে বড় চোর কিংবা দুর্নীতিবাজের তালিকায় ফেলছি তার যথাযোগ্য উত্তর আমার কাছে আছে। প্রথমেই সুইজারল্যান্ডে সুইচ ব্যাংকের কথায় আসি। সুজারল্যান্ড এমন একটা দেশ যাকে দুনিয়ার স্বর্গ রাজ্য বলে অনেকে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন । অথচ দেখেন তারা তাদের ব্যাংকে দুনিয়ার সব অসাধু মানুষের টাকা জমিয়ে রাখার সুযোগ করে দিয়ে নিজেরা কি সুন্দর সবার কাছে আদর্শ হয়ে আছে। এবার একটা মজার গল্প বলি তাহলে- ধরুন, আপনার পাড়ায় আপনি একটা সুন্দর বাড়ী বানিয়ে সেখানে খুব ভালো একটা সিন্দুক বানিয়ে রাখলেন। এবার আশপাশের গ্রামের সব চোর ডাকাতদের মাইকিং করে খবর দিলেন যে, “চোর-ডাকাত ভাই সকল আপনারা আজকের পর থেকে আপনাদের চুরির মাল নিজেদের বাড়িতে না রেখে নিরাপদে আমার সিন্দুকে রেখে যেতে পারেন।” তাতে চুরি করে ধরা পড়ে যাবার কোনো রকম শঙ্কা থাকল না। এমন খবর পেয়ে আশপাশের গ্রামের সব চোর ডাকাত মহা খুশি। পরের দিন থেকে তারা তো যার যার গ্রাম থেকে ইচ্ছেমত চুরি করে টাকা-পয়াসা, সোনা-দানা সব কিছু এনে সেই সিন্দুকে জমা দিতে শুরু করল। আর সেই সিন্দুকের মালিক হিসেবে আপনি আবার লোকটা খুব সৎ। আমানতের কোন খেয়ানত করেন না সেটা সকলেরই জানা। তবে কারও টাকা পয়সা কিংবা আমানত খেয়ানত না করলে কী, চোর ডাকাতদের রেখে যাওয়া টাকা-পয়সা ঠিকি আপনি আপনার ব্যাবসা বাণিজ্যে খাটিয়ে তার মুনাফা লাভ করে যাচ্ছেন। আপনার এই কাজ কিন্তু কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য হওয়া উচিত ছিলনা। অথচ আশপাশের গ্রামের লোকজন আপনার দামি বাড়ী, দামি গাড়ী দেখে পাশ দিয়ে হেঁটে যায় আর বলে আহ! কি সুন্দর বাড়ি, আহ! কি সুন্দর গাড়ী। লোকটা কী সৎ কারও কোন টাকা মেরে খায়না। একই রকম ঘটনা সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে ঘটছে। আপনি সেইসব দেশে বড় একজন বিনিয়োগকারী হয়ে যান, দেখবেন কিসের মুসলিম দেশের কিসের মুসলিম সরকার আপনার অবৈধ আয়ের সবটায় হালাল হয়ে যাবে এক দিনের মধ্যেই (পিন্টু মিয়াঁর মত)। লোকের মুখে শুনেছি রোজার সময় ইফতারে নাকি মালেশিয়ায় সব মসজিদে মুসল্লিদের ফ্রিতে খাবারও দেওয়া হয় । অথচ তলে তলে আন্তর্জাতিক অসাধু কাজে তারা কিভাবে ইন্দন জুগিয়ে যাচ্ছে পরোক্ষভাবে, সেটার কথায় ভাবেন একবার । আর আমরা তো হাতে হাত তালি দিয়ে তাদের সৎএবং ভালো মানুষের খেতাব দিয়ে চলেছি কী সুন্দর ভাবে। একবার ভাবুন, চুরি জিনিস বিক্রির জন্য গুলিস্তানের চোরাই মার্কেট যদি না থাকত তবে চুরি কিন্তু অনেকটা কমে যেত। কারণ চোরের চুরি করা মাল বিক্রয় করবার জন্য কিন্তু একটা মার্কেট প্রয়োজন। সেটা যদি না থাকে তবে চোরাই মাল হাতে হাতে বিক্রি করতে একজন চোর কয়টা লোকের কাছে যেতে পারবে কিংবা ভালো মূল্য-ইবা কোথায় পাবে।

এদিক থেকে হংকং এর ব্যাপারটা তো আরও বেশী মজার এবং সত্যই অত্যাধুনিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন হংকং-এ বাণিজ্যিকভাবে কোন কিছু লেনদেন করতে ব্যবসায়ীদের নাকি বাড়তি কোনো রকম কর দিতে হয় না। এহেন সুবিধা নিতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা লেনদেন হয় তাতে বিশ্বের সব বড় বড় কোম্পানির প্রধান কার্যালয় এখানে গড়ে উঠেছে। এখন তাদের এই বানিজ্যিক কার্য্যক্রম পরিচালনায় বহু জাতীয় বড় বড় কোম্পানির অফিস এবং যে লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার সেগুলি স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে গড়ে উঠেছে। আর এই দেশের সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য প্রতিটা সার্ভিস খুব উন্নত এবং দক্ষতার সাথে পালন করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে বড় কোম্পানিগুলোকে আকর্ষন করতে সামর্থ্য হয়েছে। তাই প্রতিদিন বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন আর এতে ভি.আই.পি. হিসেবে তাদের থাকা, খাওয়া এবং চিত্ত-বিনোদনের সব রকম ব্যবস্থাপনার জন্য সর্বাধিক সুযোগ সুবিধা এখানে নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন উন্নত মানের হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, পণ্য পরিবহন সুবিধা, শপিং এর সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যবসায়ীরা যে টাকা তাদের ব্যবসায় খাটাচ্ছেন সেটা না হয় ফ্রি অব চার্জ তাই বলে আপনার থাকা-খাওয়া কিংবা বিনোদনের জন্য যা কিছু দরকার সেটা তো আর ফ্রি না। যে কারনে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠান চালাতে হংকং-এ যত রকম খরচা করছেন যেমন পন্য পরিবহন, আপনার অফিস স্পেস, পরিবার কিংবা ছেলেমেয়ের জন্য অনেক দামী ব্র্যান্ডের গিফট আইটেম ক্রয় এর সবকিছু থেকে হংকং বিশাল একটা টাকা আয় করছে। এই জন্য অগনিত বড় বড় চিত্ত-বিনোদন কেন্দ্র এবং শপিং মল সহ অনেক কিছুই এখানে গড়ে উঠেছে যাতে করে উচ্চবিত্ত বিদেশীদের কাছ থেকে খুব সহজে যতটা সম্ভব টাকা হাতিয়ে নেয়া যায়।

বিষয়টা আরও সহজ করে দিতে একটা গল্প বলছি শুনুন। ধরুন, আমি আপনাকে বল্লাম, “ভাই আমি আমার এলাকায় এক ভদ্রলোককে চিনি। যিনি আপনার মত বড় ব্যবসায়ীদের অনেক সুযোগ সুবিধা সম্পুর্নরূপে ফ্রিতে দিয়ে থাকেন । আপনি যখন অনেক দুর থেকে পাশের এলাকায় পণ্য কিনতে আসেন আমি জানি, অনেক সময় তো আপনাকে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে অনেক মোটা অঙ্কের কর দিতে হয়। তাছাড়া ক্যাশ টাকা সঙ্গে রাখাও তো নিরাপদ নয়। তার চেয়ে একটা কাজ করি চলেন, সে লোকের মাধ্যমে আমরা পণ্য কেনাবেচা করি। যেমন দর দাম ঠিক হলে বিক্রেতা তার মাল সে লোকের কাছে পৌঁছে দেবে আর বিনিময়ে আপনি সরাসরি সে লোককে টাকা দেবেন আর তার কাছ থেকেই আপনার পণ্য বুঝে নেবেন।” ব্যাপারটা বলতে পারেন কোরবানির ঈদে পশু কিনে ইজারাদারের কর ফাঁকি দিতে দাম মিটে গেলে আমরা যেমন গরুর মালিককে বলি, ভাই আপনি আপনার গরু সমেত বাজারের বাহিরে চলে যান। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবেন আপনার গরু বিক্রি হয় নি। তারপর মাঝ রাস্তায় কোনো এক যায়গায় আমার লোক আপনার কাছে টাকা দিয়ে গরু বুঝে নেবে। অনেকেটা সে রকম ব্যাপার আরকি। আবার বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতে হুন্ডি বলে আমরা যেটা বুঝি অনেকটায় সেরকম পন্থায় হংকং আন্তর্জাতিক বাজারে বিদেশী ব্যবসায়ীদের কাছে মানি লন্ডারিং এর জন্য আদর্শ স্থান বলতে পারেন। তাই সবচেয়ে ভালো যে জিনিসটা সেটা হলো বিদেশীদের কাছে একটা বিশ্বাসের যায়গা তৈরি করে ফেলা। সে কাজটি ইতিমধ্যেই খুব ভালো ভাবে করতে পেরেছে হংকং সরকার। যার কারনে একদম কোনো রকম প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়ায় প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে হংকং। তার মানে এলাকার সেই লোকটার মত যে কখনও কারও টাকা-পয়সা মেরে খায় না আবার তার কাছে টাকা রাখার জন্য কোন ফিসও নেয় না। এরকম কথায় আমি আপনি আপনি তো মহা খুশি। তবে একটা কথা, আপনি যখন প্রয়োজনে রাতে লোকটার বাড়ীর পাশেই বিরাট বড় বাজারের ভালো হোটেলে থাকবেন, খাবেন। খাবারের হোটেলগুলোতে দেশ বিদেশের হরেক রকমের খাবার তো আছেই সাথে আপনি চাইলেই বিদেশী লাল পানি মানে মদ খেতে পারছেন। আর অন্য রকম বিনোদনের নেশা থাকলে যেমন নারী কিংবা জুয়া সেটারও ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া ঐ বাজারে আপনার পণ্য পরিবহনের জন্য অনেকগুলো পিক-আপ ভ্যান এবং ট্রাক আছে আপনি চাইলেই যে কোনো একটা ভাড়া করে আপনার কেনা মালপত্র নিশ্চিন্তে আপনার গুদামে নিতে পারছেন। তাছাড়া পণ্য পরিবহনে অন্য যায়গা থেকে আপনার গাড়ী ভাড়া করার দরকার-ইবা কী। এছাড়াও লোকটার বাড়ীর পাশেই সে বড় বাজার থেকে স্ত্রীর জন্য বিদেশী ব্র্যান্ডের ভালো কসমেটিক্স কিংবা ছেলেমেয়েদের জন্য ভালো খেলনা সবি নিতে পারছেন। তবে আপনি যার কাছ থেকে ব্যবসায়িক লেনদেন করছেন সেটি ফ্রি অব চার্জ হলেও, আর বাকি সব কিছুতে যেমন থাকা, খাওয়া, বিনোদন, পণ্য পরিবহন এবং ব্যক্তিগত শপিং বাবদ যা বিল আসছে সেটা আপনাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। সেটা খুব স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত বলেই এতে আপনার কোনো আপত্তি থাকবার কথাও নয়। আপনার ব্যাবসায়িক কাজে আপনাকে বিশ্বস্ততা দেখিয়ে ফ্রিতে সহযোগীতা করার ছলে লোকটি কিন্তু তার ব্যাক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। আর সে অভিনব আইডিয়া দিয়ে উন্নত দেশের অভিভাবক হিসেবে হংকং সরকার আজ তার পরিবার এবং সন্তান মানে এই দেশের নাগরিকদের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করে আমাদের সামনে আদর্শ বনে গেছেন। অথচ তাদের বাবা মানে দেশের সরকার কিন্তু সেই ‘পিন্টু’ মিয়াঁর প্রতিচ্ছবি যার আয়ের উৎস নৈতিকতা বিবর্জিত। আর এই বড় বড় আদর্শহীন লোকদের পরিবার মানে দেশ এবং তাদের সন্তান মানে নাগরিকগণ আজ বরাবর অভাবমুক্ত থেকে সমাজের কাছে তারাই সম্মানীত এবং আমাদের কাছে আদর্শের উপমা হয়ে রয়ে গেছেন।

 

২৪হেল্পলাইন.কম/এপ্রিল, ২০১৮

লেখকঃ হাসনাত বাদশা, হংকং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত বাংলাদেশী ছাত্র

By | 2018-05-12T10:28:15+00:00 April 18th, 2018|9 Comments

9 Comments

  1. 인터넷 포커 게임 October 14, 2019 at 8:23 pm

    You ought to take part in a contest for one of
    the finest websites on the internet. I am going to highly recommend this site!

  2. Food October 20, 2019 at 3:44 pm

    Soaked chickpeas, when grounded with herbs like parsley and onion-garlic then, imagine me, the aroma it offers is
    solely thoughts-blowing. Then, he merely appeared
    to accept it and moved on. Sok the chick Peas in water for not less than 8 hours.
    Grind the Chick Peas, Garlic, Onion and Parsely together, with a
    small quantity of water, adding the falafel spices, carboneh, and salt.
    Add chopped onion, garlic, parsley, cilantro, salt and pepper.
    I add everything… soaked chickpeas, cilantro, parsley
    and spices within the food processor after which grind it.
    Place the chickpeas, breadcrumbs and garlic in a food processor and
    pulse till the chickpeas break down into small pieces the dimensions of breadcrumbs.
    Such technologies could be appreciated in India’s mega food parks,” he said. Technology is utilized in food production as a result of many industrial functions need the usage of excessive technology machine to help in growing the productiveness degree of food processing. https://alba1486.com/

  3. celmaibuntv4K.freshsoftware.info November 21, 2019 at 9:38 am

    An intriguing discussion is worth comment. I believe that you need to write more about this topic, it might not be a taboo subject but generally folks don’t discuss such issues.
    To the next! Kind regards!!

  4. Ekspedisi Laut Surabaya Makassar July 10, 2020 at 5:47 am

    I now have “Drive 80 theme song in my head”.

  5. Cat Lantai July 17, 2020 at 5:22 pm

    These are type of materials that may damage any form of floor if
    sustained for long. It can be performed across the perimeter
    from the floor or only at the perimeters, forming designs or decorative borders.
    By applying an epoxy coating on the concrete, the concrete is protecting.

  6. bob marley September 9, 2020 at 2:48 pm

    I probably bought over 40 books during this time.

    My blog bob marley

  7. INVS Logistics March 31, 2023 at 9:07 pm

    Yaşamak değil, beni bu telaş öldürecek. – Özdemir Asaf

  8. konteyner nakliyat April 14, 2023 at 8:37 pm

    konteyner taşımacılığı alanında ada lojistik olarak 10 yılı aşkın süredir hizmet vermekteyiz.

  9. Özken Trafo April 28, 2023 at 11:30 pm

    İnsanlar seninle konuşmayı bıraktığında, arkandan konuşmaya başlarlar. -Pablo Neruda

Leave A Comment